সাতক্ষীরা ট্রিবিউন ডেস্ক ঃ সার- ডিলেজের মূল্য বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত কমেযাওয়া, প্রযুক্তির সমন্বয়হীনা, বীজের সংবেদনশীলতা, লবণক্ষতাসহ আমন ধানের ক্ষেতে পোকা ও রোগের আক্রমণ ও অভ্যাহত লোডশেডিং এ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় কৃষকরা। মাজরা পোকা, পামরি পোকা, চুঙ্গি পোকা, ঘাস ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িংসহ বিভিন্ন পোকা এবং পাতা ঝলসানো রোগ ও পাতা মোড়ানো রোগের আক্রমণে আমন ক্ষেতের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক বলে জানিয়েছেন তারা। পাতার উপরের অংশ হলুদ হয়ে যাচ্ছে। পরে তা ছড়িয়ে পড়েছে গাছের অন্য অংশেও। আতঙ্কিত চাষিরা আক্রান্ত গাছের নমুনা নিয়েও কৃষি দফতরে এসে জানতে চাইছেন প্রতিকারের উপায়। কৃষি বিশেষজ্ঞরা আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন। ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের মোট ৩১টি জেলায় ৮০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর আমন ধানের জমি ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার আমন মৌসুমে ধানের উৎপাদন পাওয়া নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কায় রয়েছেন কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা।
সূত্রমতে, ষাটের দশকের শুরুতে উচ্চফলনশীল বীজ, ভূ-গভীরস্থ সেচ, রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক দিয়ে ফসল উৎপাদনে সবুজ বিপ্লবের শুরু হয়ে এ অঞ্চল থেকে। দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় আট লাখ হেক্টর অধিক কৃষিজমি লবণাক্ত ও জোয়ার-ভাটার প্রভাবযুক্ত। বৃষ্টিনির্ভর এ সময়ের ধান কয়েক বছর পরপর খরায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া আমন মৌসুমের শুরুতে অসাধু ডিলাররা কখনো নিম্নমানের বীজ উফশী হিসেবে বেশি দামে এবং অনুরূপ উফশী বীজকে হাইব্রিড হিসেবে চড়ামূল্যে বিক্রয় করে। ফলে কৃষক উফশী ও হাইব্রিড বীজের ক্রয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এর পরিবর্তে নিজের বা বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে এলাকায় জনপ্রিয় স্থানীয় ও অননুমোদিত জাতের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখান। কিন্তু স্থানীয়ভাবে সে বীজ পাওয়ার ব্যবস্থা খুবই সীমিত। আমন ধান অধিকাংশই সরুও সুগন্ধি জাতের। এর বাজার মূল্য বেশি হলেও ফলন কম। এ বিষয়ে সরকারে নিবিড় গবেষণার দাবী জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ্য, মোগল আমলে বন্যাক্রান্ত এলাকায় খাজনা মওকুফ এবং সুদমুক্ত তাকাবি ঋণের ব্যবস্থা ছিল। খাদ্যনিরাপত্তার তাগিদে, বন্যার পর আমন ধান আবাদের শেষাবস্থায় পরাঙ্গি প্রযুক্তিতে দেশী জাত আবাদ হতো। এক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত উফশী বা হাইব্রিড জাত বন্যা-পরবর্তী বেশ কার্যকর খাদ্যনিরাপত্তার লাগসই প্রযুক্তি হতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
কৃষকেরা জানান, আমন মৌসুমের শুরুতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের দেখা মেলেনি। ভরা বর্ষা মৌসুমে চারদিকে মাঠের পর মাঠ বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে চৌচির হয়ে গিয়ে ছিল। তারপরও ভালো ফলনের আশায় ভূ-গভ পানি তুলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমনের ক্ষেত তৈরি করেন তারা। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মিয়াসাহেবের ডাঙ্গা গ্রামের সুরাত আলী গ জানান, প্রতি মৌসুমে ১০-১৫ বিঘা পরিমাণ আমন ধান চাষ করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় অবশেষে ভূ-গর্ভ থেকে পানি তুলে আমন চাষ করতে হয়েছে। তবে সেচ দিয়ে আমন চাষ করার কারণে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণেরও বেশি হবে। তিনি আরো বলেন, সরকার একে তো সারের দাম বৃদ্ধি করেছে, তার ওপর বিদ্যুচ্চালিত সেচযন্ত্রের মাধ্যমে আমন উৎপাদন করলে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিনি আরো জানান, অন্যান্য মৌসুমে আমন চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে ১০-১১ হাজার টাকা। সেখানে চলতি মৌসুমে ১৭-১৮ হাজার টাকা পড়ে যাবে। এর মধ্যে বিঘাপ্রতি ৫-৬ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ পড়বে শুধু পানি উত্তোলন করতে। তাছাড়া কেজিতে ৬ টাকা বেড়েছে সারের দাম। ফলে এবার আমন চাষে লোকসানের আশঙ্কা তিনিসহ অসংখ্য চাষী।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমের জন্য জেলায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৯ হাজার ৯১০ হেক্টর পরিমাণ জমিতে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর, কলারোয়ায় ১১ হাজার ৯০০, তালায় ৯ হাজার ৬০৫, দেবহাটায় ৫ হাজার ৫০৫, কালীগঞ্জে ১৭ হাজার ৫০০, আশাশুনিতে ৯ হাজার ২৬০ এবং শ্যামনগর উপজেলায় ১৬ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্য মতে, চলতি বছর আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৫৬ লাখ ২০ হাজার ৭২৫ হেক্টর। সেচযন্ত্র রয়েছে ‘দেশে প্রায় ১৪ লাখ ।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড.মোঃ জামাল উদ্দীন জানান, চলতি মৌসুমে প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু মৌসুমি বৃষ্টি না হওয়ার কারণে আমন উৎপাদনে কিছুটা অনিশ্চিয়তা থাকলেও পরে কেটে যায়। তিনি আরো জানান, কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তবে অনেকে আমাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছে না। কৃষকরা আমাদের সাথে পরামর্শ নিয়ে কীটনাশক ছিটায় না। এ ছাড়া কীটনাশকের সঠিক ডোজের ব্যবহার সময় মতো না করায় বার বার স্প্রে করতে হচ্ছে। কীটনাশক ছিটানোর সময় বিলের সব চাষিকে একসাথে কীটনাশক ছিটানোর পরামর্শ দেন তিনি।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা জানান, ‘আমন রোপনে কখনও সেচের প্রয়োজন হতো না। ফ্লাওয়ারিং স্টেজে (ধানের শীষ) কখনও কখনও সেচের প্রয়োজন হতো। কিন্তু এবার তো প্রথম থেকেই সেচ লাগছে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়গুলো টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০, রূপকল্প ২০৪১সহ শতবছরের ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর অংশ। দেশের ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমি এবং পানিসম্পদকে সুচিন্তিত পরিকল্পনামাফিক স্মার্টভাবে কাজে লাগানো গেলে বিশ্বজুড়ে খাদ্যসংকটকালে দেশে আমন ধান খাদ্যনিরাপত্তার প্রত্যাশা পূরণে অবদান রাখতে পারে। সে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।