আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: কাঁচা টক আমের আচারের চাহিদার কথা মাথায় রেখে সাতক্ষীরার বাজারে আমের ঢল নেমেছে। প্রতিদিন জেলার বাজারে শতশত মণ আম বেচাকেনা হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে কাঁচা আম জেলার বাজারে উঠলেও রবিবার থেকে বাণিজ্যিকভাবে কাঁচা আম কেনা-বেচা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মণ প্রতি আম দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় আম ক্রয় বিক্রয় হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন সুস্বাদু জাতের আগাম আম উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে সারা দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সাতক্ষীরা। ইতোমধ্যেই এই জেলা আমের রাজধানী হিসাবে বেশ সুখ্যাতি লাভ করেছে। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সাতক্ষীরায় উৎপাদিত আম বেশ সুস্বাদু হওয়ায় দিন দিন এ জেলায় উৎপাদিত আমের চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনি গড়ে উঠছে নতুন নতুন আম বাগান। চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় আমের আশানুরূপ উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন চাষি ও বাগানিরা। আর তাদের এই শঙ্কার কারণ হলো দীর্ঘসময় অনাবৃষ্টি। চলতি মৌসুমে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় খরার কারণে ঝরে যাচ্ছে আমের গুটি। বিশেষ করে আ¤্রাপালি জাতের আমের গুটি ঝরে যাওয়ার চরম সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাগানিরা ওষুধ প্রয়োগ করেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। এছাড়া অন্য বছরের তুলনায় এবছর গাছে আমের পরিমাণও খুব কম। এছাড়া যে কোন মৃহূর্তে ঝড় বৃষ্টির বার্তা শুনে চাষিরা আগের ভাগে আম ভাঙ্গতে শুরু করেছে। এতে চরম লোকশানের আশঙ্কা করছে জেলার কয়েক হাজার আম চাষী।
সূত্র বলছে গত কয়েক বছর ধরে সাতক্ষীরাসহ দেশের কয়েকটি জেলাতে বাণিজ্যিক ভাবে আম চাষে ঘটে গেছে এক বিস্ময়কর বিপ্লব। উৎপাদন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৯৪তম দেশ বাংলাদেশ। তবে আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ ১০-এ। দেশেও ফলের রাজা আম। দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় এ ফলের। সাতক্ষীরাসহ দেশের অন্তত ছয়টি জেলার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য হয়ে উঠেছে আম। বছর বছর নতুন নতুন আমবাগান হচ্ছে। তৈরি হয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। বাগান চাষ ও পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক ছাড়াও শুধু ফলনের মৌসুমেই অর্থাৎ বছরের প্রায় ৪/৫ মাস কয়েক হাজার মানুষ সারা দেশে আম সংক্রান্ত কর্মকান্ডে জড়িত থাকে।
সূত্রমতে আজ থেকে ১০ বছর আগে দেশে আমের উৎপাদন ছিল ১৩ লাখ টন। আর ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ লাখ টনে। আম উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মাথাপিছু বার্ষিক ভোগের পরিমাণ। স্বাদে, গন্ধে ও পুষ্টিগুণে আম অতুলনীয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টন। সারাদেশে ২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে বাণিজ্যিক ভাবে আম উৎপাদন হচ্ছে। অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে আমের উৎপাদন ২৪ লাখ টনের মতো। প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্য হয়। আম উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন, মোড়কীকরণ ও পরিবহন মিলিয়ে এ বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে।
দেশের ফল থেকে আসা পুষ্টি চাহিদার একটা বড় অংশের জোগান দেয় আম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে গত ১৮ বছরে বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হারে আমের চাষ বেড়েছে। বছরে ১৬ শতাংশ হারে ফলটির উৎপাদন বাড়ায় মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। আমের নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, সারা দেশে চাষ সম্প্রসারণ, কৃষকের অক্লালœ পরিশ্রম ও আধুনিক প্রযুক্ত ব্যহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে উঠে আসে । আগে সাতক্ষীরা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, মেহেরপুরের মতো কয়েকটি জেলাতেই আম চাষ সীমাবদ্ধ ছিল। আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ফলের রাজা আম এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থান করে নিয়েছে দেশের ৩০টি জেলায়।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি থেকে প্রাপ্ত জেলায় আমের বাগান রয়েছে ৫২৯৯টি। চাষীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১০০ জন। ২০১৫ সাল থেকে আম বিদেশে রপ্তানির জন্য চেষ্টা শুরু করে কৃষি বিভাগ। ২০১৬ সাল থেকে সাতক্ষীরার আম প্রথম ইতালীতে রপ্তানি শুরু হয়। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে প্রথম ২৩ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ওই বছরই কিছু আম রপ্তানি হয় ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে। রপ্তানি আয় হয় ১৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে রপ্তানি হয় ৩২ মেট্রিক টন। আয় হয় ২৪ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ২৯.৫ টন আম রপ্তানি করে আয় হয় ২১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে দশমিক ৬৯ টন আম ৪৮ হাজার টাকায় রপ্তানি করা হয়। ২০২০ সালে আম্পান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে কোন আম রপ্তানি হয়নি। এরপর ২০২১ সালে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ মেট্রিক টন। এবছর ২০২২ সালে আরো বেশি আম রপ্তানি করতে চাই জেলা কৃষি বিভাগ।
সাতক্ষীরার সুলতানপুর এলাকার কাজী মারুফ হাসানের ছেলে আম ব্যবসায়ী উজ্বালের সাথে কথা হলো। তিনি জানালেন এবছর তিনি ২৪ বিঘা জমিতে ১৫শ টি আম গাছের বাগান পরিচর্যা করবেন। এতে তার জমির হ্যারিসহ ১৭ লাক্ষ টাকা মত খরচ হবে। তবে এবছর আমের ফলন খুবই কম। কয়েক লক্ষ টাকার ক্ষতি হতে পারে এবছর।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরার মাটি ও পরিবেশ আমের জন্য অনেক সহায়ক। ফলে আমের চাষ জেলাটিতে দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবছর ও আমের উৎপাদন বাড়বে আশাবাদ কৃষিবিভাগের। আমা চাষিদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে জেলা কৃষি বিভাগ। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে সাতক্ষীলাতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে দাবী কৃষি একর্মকর্তার।
জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে পুষ্টির অভাব মেটানো, কর্মসংস্থান তথা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজারজাতকরণ এবং গুদামজাত করে দীর্ঘমেয়াদি বিপণন প্রক্রিয়া গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক, অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানসহ শিল্পোউদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে আম শিল্পের বিকাশ ঘটবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।