সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: দ্বিতীয় দফা তদন্তেও সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতির বিরুদ্ধে দশ কাউন্সিলরের করা দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ধোপে টিকছে না। ১০টি অভিযোগের মধ্যে পানির বিল, পৌরকর, ট্রেড লাইসেন্স ফি এবং পৌরসভার হাট বাজার ইজারা বাবদ ভ্যাট ও আয়কর সংক্রান্ত অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পানির বিল, পৌরকর, ট্রেড লাইসেন্স ফি এবং পৌরসভার হাট বাজার ইজারা বাবদ ভ্যাট ও আয়কর সংক্রান্ত অভিযোগ প্রমাণিত হলেও মেয়র তাজকিন আহমেদ কাউন্সিলরদের সুপারিশ ও পরামর্শে জনস্বার্থে পানির বিল, পৌরকর, ট্রেড লাইসেন্স ফি মওকুফ করেছেন। পৌরসভার হাট বাজার ইজারা বাবদ ভ্যাট ও আয়কর তিনি সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরদের সাথে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এছাড়া বাকী ৬টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
প্রথম দফা তদন্ত শেষে দ্বিতীয় দফায় অধিকতর তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা যে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন তাতে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। দশটি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে পানির বিল মওকুফ, বাজার ব্যবস্থাপনা অনিয়মের মাধ্যমে অনৈতিক আর্থিক সুবিধাগ্রহণ, ময়লা ও সেপটিক ট্যাংক পরিস্কারের সমুদয় অর্থ আত্মসাত, একক ক্ষমতাবলে পৌরকর ও ট্রেড লাইসেন্সের ফি মওকুফ, ভুয়া ভ্রমন বিল ও আপ্যায়ন বিল গ্রহণ, অনৈতিক সুবিধাগ্রহণের জন্য টেন্ডার প্রদান, দলীয় কর্মীদের প্রতিমাসে আর্থিক সাহায্য প্রদান, পৌর এলাকায় ঠিকাদারী এবং মাস্টাররোলের মাধ্যমে নিয়োগকৃত কর্মচারীদের নিজের হোটেল, ঠিকাদারী ও পরিবহন ব্যবসায় নিয়োগের বিষয়ে অভিযোগ এনেছিলেন ১০ জন কাউন্সিলর।
অভিযোগটি প্রথম দফায় তদন্ত করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মাশরুবা ফেরদৌস। তদন্ত শেষে তিনি প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে অভিযোগটির অধিকতর তদন্ত করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মো: সবুর হোসেন। তদন্ত সম্পন্ন করে তিনি চলতি জুনের ২ তারিখে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা মন্তব্য কলামে উল্লেখ করেন, সার্বিক পর্যালোচনায় মেয়র কর্তৃক ব্যক্তিগত সফরকে সরকারি/অফিসিয়াল সফর দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। বর্তমান মেয়র তাজকিন আহমেদের কর্মকালীন ছয় বছরে ১৮ লক্ষ ২৪ হাজার ২৭৫ টাকা আপ্যায়ন বিল প্রকৃত খরচের বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে। উত্তোলনের বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হয়নি।
বাজেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেই টেন্ডার আহ্বান করা হয়ে থাকে বিধায় টেন্ডারে অনিয়মের বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হয়নি।
মেয়র তাজকিন আহমেদেরর ৬ বছর কর্মকালীন সময়ে দলীয় কর্মীদের পৌরসভার আর্থিক সাহায্য প্রদান সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। ঠিকাদারী লাইসেন্স ব্যবহার করে মেয়র সাতক্ষীরা পৌরসভায় ঠিকাদারি কাজ করেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি বিধায় এ অভিযোগটিও তদন্তে আপাতত প্রমাণিত হয়নি। মেয়র তাজকিন আহমেদ পৌরসভার মাস্টাররোলের মাধ্যমে নিয়োগকৃত কর্মচারীদের নিজ হোটেল, ঠিকাদারী ও পরিবহন ব্যবসায় নিয়োগ প্রদান সংক্রান্ত অভিযোগটি তদন্তে প্রমানিত হয়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের মার্চ মাস হতে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৫৮ লক্ষ ১৯ হাজার সাত শত এক টাকা পানির বিল মওকুফ করা হয়েছে। বিল যথাযথভাবে আদায় না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়র কর্তৃক এককভাবে মওকুফ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধি-বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। অভিযোগটি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
এছাড়া, ১৪২৩-১৪২৮ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ছয় বছরে সাতক্ষীরা পৌরসভার হাট বাজার ইজারা বাবদ ৬৬ লক্ষ ৩৯ হাজার ৫৫১ টাকা বকেয়া রয়েছে। এছাড়া ভ্যাট ও আয়কর বাবদ ৩৬ লক্ষ ৭০ হাজার ৯৭০টাকা আদায় ও সরকারিখাতে জমা করা হয়নি এবং উক্ত সময়ে লব্ধ অর্থ হাট বাজার ইজারা নীতিমালা ২০১১ অনুযায়ী বন্টন করা হয়নি। বিগত তিন বছরে ময়লা ও সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি তদন্তে প্রমানিত হয়নি।
এদিকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের মার্চ হতে তদন্ত কালীন সময় পর্যন্ত ১ কোটি ২৬ লক্ষ ২২ হাজার ৯৪৩ টাকার পৌরকর মওকুফ করা হয়েছে। উক্ত পৌরকর যথাযথভাবে আদায় না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়র কর্তৃক এককভাবে মওকুফ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধি-বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। অভিযোগটি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের মার্চ হতে ২০২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১৪ লক্ষ ১৩ হাজার ৭২৬ টাকা ট্রেড লাইসেন্স ফি মওকুফ করা হয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স ফি যথাযথভাবে আদায় না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়র কর্তৃক এককভাবে মওকুফ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। অভিযোগটি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। এরআগে গত ২৭ ও ২৮ এপ্রিল সরেজমিনে তদন্ত করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম-সচিব মো: সবুর হোসেন। তদন্তকালে তিনি উভয়পক্ষের বক্তব্য লিখিতভাবে গ্রহণ করেন। এসময় সাতক্ষীরা পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীগণ লিখিতভাবে যে বয়ান পেশ করেন তা ধোপে টিকেনি বলে দাবি করেন মেয়র তাজকিন আহমেদ।
পানির বিল মওকুফের বিষয়ে মেয়র তাজকিন আহমেদ বলেন, অভিযোগকারী কাউন্সিলরগণই পানির বিল মওকুফের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। স্থানীয় সরকার পৌরসভা) আইন ২০০৯ এর ধারা ১০৪ অনুযায়ী প্রতিটি আবেদনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থায়ী কমিটি গ্রহণ করেন। আইন অনুযায়ী যে ক্ষমতা মেয়রের এখতিয়ারের বাইরে-সে ক্ষমতা অপব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। পানির বিল কমানোর এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে পৌর কর্তৃপক্ষ করে আসছে।
হাট-বাজারের টেন্ডার কার্য পরিচালনার বিষয়ে পৌর কাউন্সিলরদের অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ বলেন, পৌরসভায় সুনির্দিষ্ট টেন্ডার কমিটি আছে। যার আহ্বায়ক পদাধিকার বলে প্যানের মেয়র-১ (অভিযোগকারী)। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই সকল সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এক্ষেত্রে মেয়রের একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। এছাড়া ক্ষমতার অপব্যহার করে পৌরকর ও ট্রেড লাইসেন্সের ফি মওকুফের যে অভিযোগ করা হয়েছে তাও মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে জানান মেয়র তাজকিন আহমেদ।
মেয়র তাজকিন আহমেদ বলেন, সাতক্ষীরা পৌরসভার কাউন্সিলরদের পরামর্শ ও সুপারিশক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল কার্য পরিচালনা করা হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মহামারি করোনাকালে সুখ-দু:খের সাথী হিসেবে পৌরবাসির পাশে ছিলেন। মানুষের দু:খ-দুর্দশা লাঘবে কাউন্সিলরদের পরামর্শ ও সুপারিশে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এককভাবে তিনি কখনো কোন সিদ্ধান্ত নেননি। কাউন্সিলরদের মিথ্যা অভিযোগের কারণে গরীব-অসহায় মানুষ বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা খুবই দু:খজনক।
পৌর মেয়র আরও বলেন, আমার নামে মিথ্যা গল্প বানিয়ে যে অভিযোগ করা হয়েছিল তা দুই বার তদন্ত করে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ষড়যন্ত্রমূলক ওই অভিযোগকারীদের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো ছালা-ছুতোয় আমাকে সরিয়ে তারা সাতক্ষীরা পৌরসভাকে জিম্মি করে ফায়দা লুটতে চায়। পৌর মেয়র বলেন, যারাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ঠিক তাদের সুপারিশেই পানির বিল ও পৌরকর কমানো হয়েছিল। অথচ পৌরবাসির সাথে প্রতারণা করে যে ক্ষতি তারা করেছেন তার দায় এখন কে নিবেন?