ফিরোজ হোসেন, সাতক্ষীরা :উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। ঘুর্নি ঝড় সিডর, আম্পান, ইয়াশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় উপকূলীয় মানুষের। প্রাকৃতিক দুযোর্গ থেকে রক্ষা পেতে এই এলাকার মানুষের একটাই দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ। সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করছে বেড়িবাঁধ রক্ষার জন্য। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারী ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্কেবেটর মেশিন দিয়ে বাঁধের স্লোভের কাছ থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। বাঁধের পাশের গাছ কেটে ফেলেছে। বাঁধ ছিদ্র করে ঘেরে পানি উঠানোর জন্য পাইপ দিয়েছে। তিন ফুট মাটি দেওয়ার কথা থাকলেও এক থেকে দেড় ফুট মাটি দেওয়া হচ্ছে। এলাকাবাসি বলছে, আগামি বর্ষা মৌসুমের আগেই এই বাঁধ ধসে যাবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ সংস্কারে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। নির্ধারিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে শ্যামনগর পওর উপ-বিভাগে কর্মকতা একজন অফিস সহায়ক ও বিভিন্ন লেবার সরদাররা এই বাঁধ সংস্কারের কাজ করছেন। যে কারণে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের টুঙ্গীপাড়া-পশ্চিম দুর্গাবাটি এলাকায় বেড়িবাঁধ সংস্কারে হচ্ছে ব্যাপক অনিয়ম। ফলে উপকূলীয় দুর্যোগ কবলিত এলাকার মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য সরকারের বরাদ্দ দেওয়া কোটি কোটি টাকা পানিতে যেতে বসেছে।
স্থানীয়রা জানায়, উপকুলীয় এলাকার দুর্যোগের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বর্ধিতকরণ প্রকল্পের আওতায় সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর আওতাধীন ৫নং পোল্ডারে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে ৪ দশমিক ৯০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ জিও ব্যাগ দিয়ে সংস্কারের জন্য ৪ কোটি ১২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কুষ্টিয়ার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাক্সি এ্যাসোসিয়েট মোট ৩ কোটি ৪৯ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকার চুক্তি মূল্যে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ভামিয়া স্লুইস গেট হতে পশ্চিম দূর্গাবাটি পর্যন্ত কিলোমিটার ১০৫.৭০০ হতে ১১০.৫৭০ পর্যন্ত তিনটি চেইনেজে ভাগ করে উক্ত বাঁধ সংস্কার কাজ দরপত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। কাজের মধ্যে মাটি দিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার ও জিও ব্যাগ প্লেসিং ও ডাম্পিং রয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাক্সি এ্যাসোসিয়েট নিজেরা কাজ না করে কয়েকজন লেবার সরদার ও শ্যামনগর পওর উপ-বিভাগে কর্মরত অফিস সহায়ক মো: খোরশেদ আলমকে সাব কন্ট্রাক্ট দিয়েছেন। খোরশেদ আলম আবার লেবার সরদারকে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছেন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-১ এর ৫ পোল্ডারের চেইনেজ ১০৭.৭৮০ কিলোমিটার হতে ১১০.১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত মোট ২.৩২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৯৩০ মিটার বাঁধের সংস্কার কাজের সাব কন্ট্রাক্ট নিয়েছেন শ্যামনগর পওর উপ-বিভাগে কর্মরত অফিস সহায়ক মো: খোরশেদ আলম। তার এই অংশের সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। দরপত্র অনুযায়ি বেড়িবাঁধের নদীর পার্শ্বে স্লোভ ২৪ ফুট, ভূমির পাশে স্লোভ ১৪ ফুট, বাঁধের উপরে (মাথা) প্রশস্ত ১৪ ফুট এবং উচ্চতা পুরাতন বাঁধ থেকে ৩ ফুট হওয়ার কথা। কিন্তু দরপত্র অনুযায়ি খোরশেদ আলম কাজ করছেন না। অধিকাংশ স্থানে বাঁেধর উচ্চতা এক থেকে দেড় ফুটের বেশি হচ্ছে না। বাঁেধর মাথা ও দুই পাশের স্লোভও অনেক কম হচ্ছে। এছাড়া স্কেবেটর মেশিন দিয়ে বাঁধের স্লোভের কাছ থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। যে কারনে তার সংষ্কার করা বাঁধ ইতিমধ্যে অনেক স্থানে ধ্বসে পড়েছে। এছাড়া প্লেসিং ও ডাম্পিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা জিও ব্যাগে বালুর পরিমান কম দেয়া হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ি ডাম্পিংয়ের ব্যাগে ২২০ কেজি ও প্লেসিংয়ের ব্যাগে ১৭৫ থেকে ১৮০ কেজি বালু ভারার কথা থাকলে অধিকাংশ জিও ব্যাগে বালুর পরিমান কম দেয়া হচ্ছে। ফলে নতুন সংস্কার করা বেড়িবাঁধ থেকে যাচ্ছে ঝুঁকির মধ্যে। পাউবো অফিসের স্টাফ হওয়ায় খোরশেদ আলম অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তিনি বাঁধ সংস্কারের কাজে এই অনিয়ম করে চলেছেন।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি পূর্ব দূর্গাবাটি গ্রামের বাপি মন্ডল বলেন, প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে টিকে আছি আমরা। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হলেই দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। সরকার প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণে বাঁধ সঠিকভাবে মেরামত করা হয়না। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে শ্যামনগর পওর উপ-বিভাগে কর্মরত অফিস সহায়ক মো: খোরশেদ আলম এই এলাকার প্রায় সব বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ করেন। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের টুঙ্গীপাড়া থেকে পশ্চিম দূর্গাবাটি পর্যন্ত বাঁধের কাজ তিনিই করছেন। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তিনি যেনতেনভাবে বাঁধ সংস্কারের কাজ করে সরকারি অর্থ লোপাট করে কোটিপতি বনে গেছেন। যে কারনে প্রতিবছর বাঁধ ভেঙে যায়। রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তাহলে কোন উন্নয়ন কাজ সঠিকভাবে হওয়ার কথা নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাউবো’র বেড়িবাঁধ সংস্কারে অনিয়মের একই ধরণের অভিযোগ করেন ওই এলাকার আহছানুর রহমান, লুৎফর রহমান মোল্যা, বিকাশ মন্ডল, খালেক সরদার ও কালিপদ মন্ডল প্রমুখ।
তবে শ্যামনগর পওর উপ-বিভাগে কর্মরত অফিস সহায়ক মো: খোরশেদ আলম সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ করার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
বুড়িগোয়ালিনী ইউপি চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, আমার ইউনিয়নে অধিকাংশ বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড যেনতেনভাবে এসব বাঁধ সংস্কারের কাজ করে থাকে বলে প্রায় প্রতিবছর বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। আমার ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে কিছু স্থানে অনিয়ম হচ্ছে বলে আমি জানতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজের সাথে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় এঅবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আবুল খায়ের বলেন, সাব কন্ট্রাক্ট দিয়ে বেড়িবাঁধের কাজ করানো যাবে না। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো। তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাক্সি এ্যাসোসিয়েট কাজ এখনো বুঝে দেয়নি। কাজ চলমান রয়েছে। বর্ষার কারণে কাজে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমরা সরেজমিনে কাজ দেখে নিব।তিনি আরো বলেন, শ্যামনগর পওর উপ-বিভাগে কর্মরত অফিস সহায়ক মো: খোরশেদ আলম ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানোর কাছ থেকে সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে বেড়িবাঁধের কাজ করার বিষয়টি আমরাও জানতে পেরেছি। যে কারনে ২৯ সেপ্টেম্বর এক আদেশে তাকে শ্যামনগর থেকে বদলি করে পাউবো’র সাতক্ষীরা বিভাগীয় দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছ।
পূর্ববর্তী পোস্ট