ডেস্ক রিপোর্ট ঃ
বেশ কয়েকবছর ধরে দেশের ছোট-বড় সকল পর্যায়ের ইসলামী দলগুলোকে সাধারণ মানুষের পাশে সহায়তার মানসিকতা নিয়ে দাঁড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। সম্প্রতি তাদের কার্যক্রম বহুগুণ বেড়েছে। যা সাধারণ মানুষের মনে দাগ কেটেছে। হঠাৎ করে তাদের এমন সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনাও চলছে। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলছেন অনেকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবায়দা নাসরিন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবায়দা নাসরিন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবায়দা নাসরিন বাংলাভিশনকে বলেন, ‘এরা পরগাছার মতো না থেকে নিজস্ব ভোট ব্যাংক তৈরি করতে চায়। যার কারণে তারা সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ৭১ এর ঘটনায় গণমানুষের চাওয়ার প্রেক্ষিতে একটি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। একটা সময়ে জাতীয় সংসদে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ থাকতো, সেটা ধীরে ধীরে কমে এসেছে। তাই তারা এখন গণমানুষের কাছে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে মিশছে। ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতি থেকে নিজেদের বের কর করতে।’
তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর বাইরে অন্য যেসব ইসলামি রাজনৈতিক দল আছে চরমোনাইর ইসলামী আন্দোলন, শরশিনা, খেলাফত, জমিয়ত তারা এখনও নিজস্ব একটি ঘরানা তৈরি করতে পারে নাই। তাদের বোধোদয় হয়েছে, পরগাছা হয়ে না থেকে একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি করার। যাতে ভোটের মাঠে নিজেদের অবস্থান জানাতে পারে।’
২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে রাতের শেষভাগে যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি অভিযানে আগুন লাগে। ওই ঘটনায় অন্তত ৪০ জন মারা যান। তখন দেশের বৃহৎ ইসলামি দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, তাদের ছাত্র সংগঠন এবং চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, তাদের সহযোগী ও ছাত্র সংগঠন উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেন। ক্ষতিগ্রস্তদের দেন আর্থিক সহায়তা। এরপরই কথা ওঠে রাজনৈতিক ভিত্তি শক্ত করতেই তারা জনকল্যাণমূলক এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এরমেধ্যে ছোট-বড় বেশিরভাগ দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় তারা অংশ নেয় সংগঠনগুলো।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডেও দেখা গেছে ইসলামী দলগুলোর তৎপরতা। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিতে দেখা যায়। একই কাজে অংশ নেয় জামায়াতে ইসলামীও। দলটির কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমান অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। আগুনে সাধারণ মানুষদের মধ্যে যারা আহত এবং নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের জন্য ৩০ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন। এই কাজে পিছিয়ে ছিলো না দুই দলের ছাত্র সংগঠনও।
সিলেট অঞ্চলের ভহাবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবধরণের মানুষের অংশগ্রহণ লক্ষ করা গেছে। এরমধ্যে সবার আগে আলেম-ওলামা এবং ইসলামী দলগুলো দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
সরেজমিনে, সিলেটের একাধিক এলাকায় রেইনকোট পরে, ভিজে, নৌকায় ঘুরে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমান। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে তিনিই প্রথম বন্যাকবলিত এলাকায় যান। প্রথম দফায় সিলেট-সুনামগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ৫০ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেন। দ্বিতীয় ধাপে ওই অঞ্চলের জন্য ৬০ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পাঠান। মঙ্গলবার (২১ জুন) তৃতীয় ধাপে আরও এক কোটি টাকার আর্থিক অনুদান ঘোষণা করে দলটি। একই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ওষুধ ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রাখছে তারা। এছাড়া তাদের সমর্থিত প্রায় শতাধিক এনজিও বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রসংগঠনের সকল স্তরের নেতারা একাধিক টিম করে বন্যার্তদের জন্য কাজ করছেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান
দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় এমন অংশগ্রহণ সম্পর্কে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘তারা মানুষকে সহায়তা করতে যাননি। তারা গেছেন তাদের প্রিয় ভাই-বোনদের দুঃখ-দুর্দশা ভাগ করে নিতে। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জামায়াত সবসময় পাশে ছিল, সামনেও থাকবে। সিলেট-সুনামগঞ্জে পাঁচ কোটি টাকার উপরে আর্থিক সহায়তার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বাংলাদেশে একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানায়।
অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা-কর্মীরাও উদ্ধার তৎপরতাসহ দুর্গম এলাকায় গিয়ে খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। দলটির সিনিয়র নেতারাও এই কাজে অংশ নিয়েছেন। সোমবার (২০ জুন) সারাদিন যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। তাদের আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বুধবার (২২ জুন) সিলেটে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বিভিন্ন শুভাকাঙ্ক্ষিরাও সিলেট বিভাগে রয়েছেন। নৌকা ভাড়া করে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মানুষের মাঝে ফুডপ্যাক বিতরণ করছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও খাবার সরবরাহ করছেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি মানুষের কল্যাণের জন্য। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। দেশের সকল নীতিবান, ভালো মানুষ ও আদর্শ নাগরিকদের নিয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চাই। সংঘাতের নোংরা রাজনীতির অবসান চাই। আমরা স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য অর্জনে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।”
তিনি বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করবো। সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত হবে। প্রতিহিংসা ও জিঘাংসার পরিবর্তে সমঝোতা ও সহনশীলতার রাজনীতির বিকাশ ঘটবে। সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমাবো। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বেকারত্ব দূর করবো এবং কৃষক-শ্রমিকসহ সব শ্রমজীবী ও পেশাজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।’
ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ছোট সংগঠন জমিয়তে ওলামা ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি এক কোটি টাকা সহায়তা ঘোষণা করেন। খেলাফত মজলিসের কয়েকটি টিম কাজ করছে বন্যাকবলিত এলাকায়। এছাড়া ইসলামী বক্তা আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ ৫০ লাখ টাকা, সৈয়দ হাসান আল-আজহারি ১৩ লাখ টাকা দেয়ার কথা বলেছেন। শায়খ আহমাদুল্লাহর আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের উদ্যেগে ২০ টন চিড়া, আড়াই টন চিনি, ৩০ টন খেজুর, ১ টন শিশুখাদ্য (গুঁড়ো দুধ), ১০ হাজার মোমবাতি, ৩০ হাজার লিটার মিনারেল ওয়াটার এবং বিভিন্ন পদের ১৮ হাজার পিস ওষুধ পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ৫ টন ছাতু এবং ১ ট্রাক গরুর খাদ্য (ভূসি) বিতরণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০ হাজার পরিবারের জন্য চাল, ডাল, তেল, লবন, খেজুর ও সাবান ইত্যাদি প্যাকেজিংয়ের কাজ চলমান আছে।
এছাড়া সিলেটের ইসলামী বক্তা মাওলানা এম হাসিবুর রহমান বুধবার সুনামগঞ্জের পাঁচ উপজেলার জন্য ২০ টন খাদ্যসামগ্রী প্যাকেট করেছেন।