স্টাফ রিপোর্টার: গেল বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ভোররাতে মুহুমুহু বোমা ও গুলি বর্ষন করে আতংক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া মৌজার ৩০টি খন্ডে বিভক্ত খলিশাখালী নামক ব্যাক্তি মালিকানাধীন ৪৩৯.২০ একর (১৩২০ বিঘা) সম্পত্তির মৎস্য ঘের জোরপূর্বক দখল করে নেয় ভূমিহীন নামধারী কয়েকশ ভূমিদস্যু ও অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। জবরদখল পরবর্তী বিস্তৃর্ণ ওইসব মৎস্যঘের থেকে কমপক্ষে কোটি টাকার বাগদা চিংড়ীসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও ঘেরের বাসায় থাকা আসবাবপত্র, গবাদিপশু লুট করে নেয় জবর দখলকারীরা। সেসময় মৎস্য ঘেরগুলোর মালিক ও সেখানে দায়িত্বরত কর্মচারীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের মালিকানাধীন জমি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে গোটা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় ভূমিদস্যুরা। এরপর কেটে গেছে চারটি মাস, তবুও ভূমিদস্যুদের কবল থেকে জবরদখলকৃত সম্পত্তি পুনরূদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের অনুকূলে ফিরিয়ে দিতে পারেনি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। একদিকে রেকর্ডীয় সম্পত্তি জবরদখল এবং লাখ লাখ টাকার মাছ লুট অপরদিকে ব্যাংক ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে গত চারমাস ধরে জমি ফিরে পেতে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভুক্তভোগী ওই জমির প্রায় ৩শ মালিক। এঘটনায় আদালত ও থানা মিলিয়ে এপর্যন্ত কমপক্ষে হাফ ডজন পাল্টাপাল্টি মামলা করেছে জমির মালিকপক্ষ ও ভূমিদস্যুরা।
সর্বশেষ গেল নভেম্বর মাসের জেলা ভূ-সম্পত্তি জবরদখল ও পুনরূদ্ধার সংক্রান্ত সভায় খলিশাখালী নামীয় গোটা সম্পত্তি সুস্পষ্টভাবে ব্যাক্তি মালিকানাধীন উল্লেখ করে সেখান থেকে জবর দখলকারী ভূমিহীন নামধারী ভূমিদস্যুদের উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত ওই সভার রেজুলেশনে বলা হয়েছে, ‘খলিশাখালী নামক ৪৩৯.২০ একর জমি সম্পূর্ন ব্যাক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি, খাস সম্পত্তি নয়। এই জমি অবৈধ দখলদারদের খালি করতে হবে। নইলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে’। সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘সরকার ভূমিহীনদের খাস সম্পত্তিতে ঘর করে দিচ্ছে। উক্ত ব্যাক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি ভূমিহীনদের দেয়া যাবেনা’। ইতোমধ্যেই এসংক্রান্ত চিঠি দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দেবহাটা থানার ওসিসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পৌঁছেছে। বর্তমানে খলিশাখালীর ব্যাক্তি মালিকানাধীন জমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে কঠোর অবস্থানে রয়েছে উপজেলা ও জেলা প্রশাসন।
এদিকে প্রশাসনের এমন কঠোর অবস্থান এবং বিদায় ঘন্টা শোনার পর থেকে খলিশাখালীর জবরদখলকৃত গোটা সম্পত্তি আকড়ে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সেখানে অবস্থানরত ভূমিদস্যুরা। ইতোমধ্যেই খলিশাখালিতে ঢুকে পড়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকার দাগী অপরাধী, অবৈধ অস্ত্রধারী ভূমিদস্যু ও কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী। খলিশাখালিতে অবস্থানরত ভূমিদস্যুদের একাংশ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, শুরুর দিকে খলিশাখালি দখলে মুল নেতৃত্বে ছিল ইছাদ আলীর ছেলে আনারুল এবং শাহজাহান গাজীর ছেলে রবিউল। দখলের পরপরই তারা সেখানকার কথিত ভূমিহীন কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারী বনে যায়। গোটা সম্পত্তি থেকে কোটি টাকার মাছ লুটের পর টাকার বিনিময়ে সেখানকার খালি জমিতে ভূমিহীন নামধারী পরিবার বসানো শুরু করেছে তারা। প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার হারে টাকা নিয়ে ১০কাঠা করে জমির দখল দিচ্ছে ভূমিদস্যুরা। বিঘাপ্রতি ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় খলিশাখালির জবর দখলকৃত ব্যাক্তি মালিকানাধীন জমি প্রতিনিয়ত সেখানে অবস্থানরত পরিবারের কাছে বিক্রি করছে ভূমিদস্যুরা। বর্তমানে আনারুল ও রবিউল ছাড়াও সেখানকার নেতৃত্বে মাতব্বর নামধারী ৫৫ জন ব্যাক্তি রয়েছে। যারা প্রত্যেকে এধরনের ৩০ থেকে ৫০ টি করে পরিবার খলিশাখালির জমিতে বসিয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে খলিশাখালীর জমিতে দেড় হাজারের বেশি পরিবারকে খলিশাখালিতে বসিয়ে আরও প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা। বর্তমানে ৬টি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও লাঠিয়াল বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রশাসনের উচ্ছেদাভিযান ঠেকাতে তাদেরকে খলিশাখালীতে রাখা হয়েছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত দেশি বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র ও হাতবোমা রয়েছে। সেখানে অবস্থানরত অস্ত্রধারী বাহিনীর মধ্যে কুখ্যাত আকরাম ডাকাতের নেতৃত্বাধীন আকরাম বাহিনী, স্থানীয় এক মেম্বরের নেতৃত্বাধীন অস্ত্রধারী বাহিনী, কুখ্যাত গফুর মাস্তানের নেতৃত্বাধীন বাহিনী, মুর্শিদ ও শাহিনুরের যৌথ বাহিনী এবং অহিদুল ও মনি’র নেতৃত্বাধীন বাহিনীটি অন্যতম। আরও রয়েছে কালু গাজীর ছেলে সিদ্দিক গাজী, আকরাম ঢালীসহ জেলার বহু দাগী অপরাদী। দিনের বেলা এসব অস্ত্রধারী বাহিনী খলিশাখালীর আশপাশে আত্মগোপনে থাকলেও, সন্ধ্যার পর থেকে গোটা খলিশাখালী জনপদ দাপিয়ে বেড়ায় এসব বাহিনীর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকে এক বা একাধিক দেশি বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র। সূত্রটি আরো জানায়, খলিশাখালির ভূমিদস্যুদের মধ্যে মুল নেতৃত্বে থাকা ৫৫ জনের মধ্যে আনারুল ও রবিউল ছাড়াও পাশ্ববর্তী নোড়ারচকের কথিত ভূমিহীন সভাপতি আব্দুল গফফার, মৃত অছেল গাজীর ছেলে আবুল হোসেন গাজী, ময়নুদ্দীন সানার ছেলে আমজাদ সানা, মৃত ধোনাই সানার ছেলে গোলাম সানা, খলিশাখালীর গোলাপ ঢালী, মোহর আলীর ছেলে ইছাদ আলী ও জামাত আলী, আবুল গাজীর ছেলে রাজু হোসেন, রিপন হোসেন, বাক্কার গাজীর ছেলে সাইফুল ইসলাম, মৃত সুবহান গাজীর ছেলে ফিরোজুল ইসলাম, কালাবাড়িয়ার আসাদুল ইসলাম, খলিশাখালির ওমর ফকিরের ছেলে শরিফুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম, গফফার সরদারের ছেলে আব্দুল্যাহ, রহমদ্দী কারিকরের ছেলে রজব আলী, সেলিম কারিকরের ছেলে মামুন হোসেন, বাক্কার শেখের ছেলে সাইফুল শেখ, এনতাজ সরদারের ছেলে সিদ্দিকুর রহমান, মুনসুর গাজীর ছেলে ইয়াছিন, শাহজাহানের ছেলে তৈমুর, হাকিম মীরের ছেলে হালিম, একই এলাকার নূর আলী, রবিউল, শাহিন, রাজ্জাক, বাবলু, হোসেন মাতব্বরের নেতৃত্বে রয়েছে। সূত্রটি জানায়, খলিশাখালীর এসব ভূমিদস্যুদের মদদদাতা রয়েছে কয়েকজন। তারা উপরে বসে কলকাঠি নাড়েন, নির্দেশনা দেন, আইনী জটিলতা বা অন্য কোন ঝামেলা সৃষ্টি হলে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সেসব ঝামেলা নিষ্পত্তি করেন। উপরে বসে কলকাঠি নাড়া ব্যাক্তিদের মধ্যে দেবহাটা উপজেলা পরিষদের একজন জনপ্রতিনিধিও রয়েছে, যিনি গত কয়েকমাসে এসংক্রান্ত বিষয়ে বহুবার ঢাকাগমন করেছেন বলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও, কয়েকমাসে অন্য কাজে একাধিকবার ঢাকাগমনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ওই জনপ্রতিনিধি।
ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীদের অবৈধ অস্ত্রের ঝলঝনানি এবং চলমান দখলদারিত্ব থেকে অবিলম্বে খলিশাখালীর ৪৩৯.২০ একর জমি পুনরূদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন কাজী গোলাম ওয়ারেশ, ডা. নজরুল ইসলাম, আনছার হাজীসহ ওই জমির রেকর্ডীয় মালিকেরা।
খলিশাখালী থেকে অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের উচ্ছেদ প্রসঙ্গে দেবহাটা থানার ওসি শেখ ওবায়দুল্যাহ বলেন, জবরদখলকৃত যাবতীয় সম্পত্তি ব্যাক্তি মালিকানাধীন বলে সুষ্পষ্ট মতামত দিয়েছেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক। তাছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসক ওই সম্পত্তি কন্ট্রোল ও ম্যানেজমেন্ট করতে পারবেন। কিন্তু খলিশাখালী জবরদখল করে তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ ভূমিদস্যুদের থাকার কোন সুযোগ নেই।
দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, জেলা প্রশাসনের ভূ-সম্পত্তি জবরদখল ও পুনরূদ্ধার সংক্রান্ত সভার রেজুলেশন পেয়েছি। সে মোতাবেক রেজুলেশনের সিদ্ধান্ত সমূহ বাস্তবায়নে উপজেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে। শীঘ্রই খলিশাখালীর জমি ছেড়ে দিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
পূর্ববর্তী পোস্ট