শাহ জাহান আলী মিটন ঃ
নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয় সাধারণত খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রাথমিক পরিচর্যা । কিন্তু সাতক্ষীরায় কয়েক বছর যাবত পর্যায়ক্রমে দেখা দিয়েছে খেজুররসের সংকট। ইতিমধ্যে হিমহিম ঠান্ডা হাওয়ায় শীতের রাত্রি শেষে, শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় সারিসারি মুক্তাদানা মনভরিয়ে দিতে শুরু করেছে । আর এসময়ে সাতক্ষীরার গ্রামে গ্রামে গাছিরা খেজুর গাছ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত থাকার কথা। কালের বিবর্তনে সময়ের পরিক্রমায় গাছ ও গাছির সংকটে সাতক্ষীরা থেকে বিলুপ্তির পথে মনোমুগ্ধকর গ্রাণ সমৃদ্ধ খেজুরের রস।
কয়েক বছর আগেও শীতের মৌসুম আসলে সাতক্ষীরায় রস আহরণ কারি বহু গাছিরা গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে রস আহরণের জন্যে অগনিত খেজুর গাছ পরিষ্কার করতেন। পরিষ্কার করার ১৫-২০ দিন পরে পুনরায় চাছ দিয়ে এরপর ছাটা অংশের যেখানে রস নিঃসরণ শুরু করা হয় সেখানে ‘ট’ আকৃতির চিকন প্রায় ৭-৮ ইঞ্চি লম্বা বাঁশের কঞ্চি আধা ইঞ্চি পরিমাণ গাছে ঢুকিয়ে(ছোট কলস) ভাঁড় পাতার ব্যবস্থা করতেন। গাছে (ছোট কলস) ভাড় উঠলেই সাতক্ষীরা ব্যাপী শুরু হতো জামাই মেয়ে দাওয়াত আর পিঠা -পায়েস খাওয়ার উৎসব।
খেজুরের রসের মনমুগ্ধকর ঘ্রাণে সকাল হলেই শিশু, কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধারা মিলে গাছের তলায় জড়ো হতেন কাঁচারস খাওয়ার জন্য । আর গ্রামের দাদিরা ব্যাস্ত সময় পারকরতো পুতাপত্নী নিয়ে রস জালাতে। সেইসব দৃশ্য এখন তেমন একটা নেই বল্লেই চলে। এছাড়াও বহু পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করত খেজুর রস বিক্রির মাধ্যমে। খেজুর রসের পাটালি গুড়েরও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে । সাতক্ষীরা থেকে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে অন্য সব পেশায় চলে যাচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় অল্পসংখ্যক গাছ থাকলেও এখন মেলছেনা গাছি।
খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার একাধিক কারন আছে বলে মনেকরেন অভিজ্ঞ মহল ও গাছিরা। গ্রামাঞ্চালে কম খরচে গৃহ নির্মাণের কাজে খেজুরগাছ ব্যবহৃত হওয়ায় কমে আসছে গাছের পরিমাণ। ইতিমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খেজুর গাছের অস্তিত্বের উপর। এছাড়াও প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কারণে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খেজুরের রস তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে এখন আর দেখা মেলে না শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে রসে বোঝাই (ছোট কলস) ভাড় কাঁধে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরী করার সেই মনরোম দৃশ্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের প্রতীক খেজুর গাছ। পাশাপাশি অর্থকরী সম্পদও। আবহমান গ্রাম বাংলার মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে এ গাছের সর্ম্পক অতি পুরনো ও নিবিড়। পূর্বে গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি গ্রামের রাস্তার দু’পাশে কিংবা বাড়ির আশেপাশে খেজুর গাছ সারিসারি দেখা মিলতো।
শীত মৌসুম আসা মাত্রই প্রতিটি খেজুর গাছে গাছিরা (ছোট কলস) ভাড় দিয়ে সুস্বাদু রস সংগ্রহ করতো। বউ-জামাই ও নাতি-নাতনী, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে শীতের দিনে রসের পাটালিগুড় ও পিঠা তৈরির ঐতিহ্যগুলি বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রায় বিলুপ্তির পথে।
বিশেষ করে শীত মৌসুমের শেষে (ছোট কলস) ভাড়ে জমাকৃত খেজুরেরগুড় আত্মীয় স্বজনদের দেয়া হতো। মাত্র কয়েক বছর আগেও সাতক্ষীরার বিভিন্ন গ্রামে খেজুর গাছে রসের (ছোট কলস) ভাড় ঝুলে থাকার দৃশ্য দেখা যেতো।
কিন্তু কালের আবর্তেনে অপরিকল্পিত ভাবে রস সংগ্রহ করা এবং নতুন করে খেজুর গাছ না লাগানোর কারনে খেজুর গাছ বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।
বর্তমানে আর মাঠের ধারে, পল্লীর নিভৃতে গেঁয়ো পথের পাশে সারি সারি খেজুর গাছের দৃশ্য চোখে পড়েনা। চোখে পড়ে না খেজুর গাছে রস সংগ্রহের মাটির (ছোট কলস) ভাড়।
প্রান্তিক কৃষকদের জমির সীমানায় এবং বসত ভিটায় এক দুটি খেজুর গাছ লাগানো এবং সংরক্ষণে উৎসাহিত করার জন্য কৃষি অধিদপ্তরকে টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি, বাংলার পুরনো সংস্কৃতি ধরে রাখতে সরকারি বেসরকারি উভয় পর্যায়ে সমানভাবে কাজ করে যেতে হবে। তবেই বাঁচবে খেজুর গাছ ও রস, বাঁচবে বাংলার ঐতিহ্য।
সাতক্ষীরা শহরের নিকটবর্তী শাল্যে, মাছখোলা, দামারপোতা,লাবসা,বকচরা,আগরদাঁড়ি,ব্রক্ষ্মরাজপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রচুর গাছ দেখতে পাওয়া যেত। যা এখন বিলুপ্তির পথে প্রায়। কিছু কিছু গাছ কাটা হলেও গাছি সংকটে কোন একসময় এগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এখনই যথোপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহন আশু প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। তা না হলে অতিশীঘ্রই খেজুরের রস বইয়ের পাতায় আর মানুষের মুখের গল্প হয়ে থাকবে।