সাতক্ষীরা ট্রিবিউন ঃ বৈরী আবহাওয়া, পানির সংকট ও মাজরা পোকার আক্রমণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আমন উৎপাদন। অন্য যে কোন বছরের তুলনায় এবার আমনের ফলন কম হয়েছে। আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও ধানে চিটা হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন উপকূলীয় অঞ্চলের আমন চাষিরা। আর এ কারণে উৎপাদন খরচও উঠছে না চাষিদের। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের অভিযোগ, যথা সময়ে কৃষি অফিসের পরামর্শ না পাওয়া ও সার-সেচ সুবিধার অভাবের কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে উৎপাদন ও মজুত কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া চলতি বছওে ২৪ অক্টোবর দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এ দেশের মোট ৩১টি জেলার আমন ধানের আবাদি জমি নানা মাত্রায় আক্রান্ত হয় বলে সংশৃষ্ট সূত্র জানায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এসব জেলায় আমন আবাদে ব্যবহূত মোট ৮০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এর বাইরেও বিপুল পরিমাণ আবাদি জমির ধানে চিটা পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সব মিলিয়ে এবার আমন মৌসুমে চালের কাক্সিক্ষত উৎপাদন পাওয়া নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কায় রয়েছেন কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা। এছাড়া আগামী বছর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে । সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দেশেও খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আসন্ন এ সংকট মোকাবেলায় উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিতের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারি ভাষ্যমতে, ২০২২ সালের বন্যায় সারা দেশের ৩৭টি জেলায় আমন ফসল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারি হিসাবে এ বন্যায় ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়।
দক্ষিণাঞ্চলের অধিভুক্ত খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫ লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ হেক্টর। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই অঞ্চলে রোপা আমন (হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের) বীজতলার লক্ষ্যমাত্রা ১৭ হাজার ৩৫২ হেক্টর। অপরদিকে, চলতি অর্থবছরে এ অঞ্চলে রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৯৯ হাজার ১১০ হেক্টর। কৃষি খাতে (শস্য উপখাত, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য উপখাত এবং বন উপখাত নিয়ে গঠিত) প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস চাল উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হারকে প্রভাবিত করেছে। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, কৃষিতে এক সময়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধিহার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে তলানিতে ঠেকেছে। সরকারি তথ্য মোতাবেক, ২০০৯-১০ অর্থবছরের ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিহার ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশে, যা বিবিএসের সাময়িক প্রাক্কলন অনুযায়ী হ্রাস পেয়ে (২০২১-২২) অর্থবছরে ২ দশমিক ২০ শতাংশে দাড়াঁয়। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে চাল উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে ছিল আমন। ওই বছর আমন ও বোরোর উৎপাদন দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮৮ লাখ ৫০ হাজার এবং ৮১ লাখ ৩৭ হাজার টন। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে আমন ও বোরোর উৎপাদন দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭৭ লাখ ৩৬ হাজার এবং ১ কোটি ৫ লাখ ৫২ হাজার টন (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০৫)।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১ অনুযায়ী ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ অর্থবছরগুলোয় যখন বোরো চালের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ কোটি ৮০ লাখ ১৬ হাজার, ১ কোটি ৯৫ লাখ ৭৬ হাজার, ২ কোটি ৩ লাখ ৮৯ হাজার এবং ২ কোটি ১ লাখ ৮১ হাজার টন, তখন আমনের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৫৬ হাজার, ১ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার, ১ কোটি ৪০ লাখ ৫৫ হাজার এবং ১ কোটি ৫৫ লাখ ২ হাজার টন। খরার কারণে চলতি অর্থবছরে আমন আবাদের শুরুটা ভালো হয়নি। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, গত ৪১ বছরের মধ্যে এ বছরের জুলাই মাসে (১৭ আষাঢ়-১৬ শ্রাবণ) দেশে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। কৃষকরা জানান, আমন রোপণের জন্য এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই বীজতলা তৈরির পর মধ্যজুন থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে আমনের চারা রোপণের সঠিক সময়। এরপর আমন রোপণ করা গেলেও তাতে ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেশি হয়। যে কারণে এবছর চলতি মৌসুমে আমন ধানে পোকার আক্রমণ বেশি দেখা দিয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় ৮৯ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ৮৮ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে হাইব্রিড ধান তিন মেট্রিক টন, উফসি ২.৭০ মেট্রিক টন ও স্থানীয় এক দশমিক ৬৫ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফলন না হওয়ায় ধান গাছ কেটে বস্তায় ভরে বাড়িতে গরু ছাগলের খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে ধান গাছ তড়িঘড়ি করে কেটে সরিষা চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করছেন। শ্যালো মেশিনের পানির বিল, সার ও কীটনাশকের দোকানের বকেয়া পরিশোধ করতে পারবেন না কৃষকরা।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড.মোঃ জামাল উদ্দীন জানান, চলতি মৌসুমে প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হচ্ছে। তিনি বলেন দ্রুত ধান কেটে আগাম সরিষার চাষের প্রণোদনার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে কৃষকদের। তা ছাড়া ওইসব জমিতে ইরি ও সবজি চাষ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন মৌসুমি বৃষ্টি না হওয়ার কারণে আমন আবাদের শুরুতে কিছুটা অনিশ্চিয়তা দেখা দিলেও উৎপাদনের লক্ষ মাত্রা অর্জিত হবে। যে কারণে জেলা কৃষি খামার বাড়ির পক্ষ থেকে আমন চাষিদের বার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।