ডেস্ক রিপোর্ট,ঃঃ ২০২০ সালে কুড়িগ্রামে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলোচনায় আসেন সিনিয়র সহকারী সচিব (তৎকালীন আরডিসি) নাজিম উদ্দিন। পরে সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী (সিইও) হিসেবে পদায়ন পান তিনি। পদায়নের পর থেকেই অধস্তন ও এলাকাবাসীর কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছেন নাজিম উদ্দিন। মূলত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ত্রাস ছড়াচ্ছেন এই সরকারি কর্মকর্তা।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন নাজিম উদ্দিন। ঘুষ বাণিজ্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ, ক্রসফায়ারের হুমকি, নির্বাহী কোর্ট বসিয়ে জেল-জরিমানার হুমকি, চাকরি থেকে অব্যাহতির হুমকি— এমনকি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে মাদক সেবন ও বহনের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
নাজিম উদ্দিন নিজের মোবাইল বিকাশ অ্যাকাউন্টে ঘুষের টাকা নিতেননাজিম উদ্দিন নিজের মোবাইল বিকাশ অ্যাকাউন্টে ঘুষের টাকা নিতেন
ঘুষ বাণিজ্য
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাতক্ষীরায় পদায়নের পর থেকেই প্রধান নির্বাহী নাজিম উদ্দিনের ‘বিশ্বস্ত হাত’ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন পৌরসভায় দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে কর্মরত কাজী বিরাজ হোসেন। যিনি ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সাতক্ষীরা পৌরসভার নির্বাহী আদেশ পালন করে আসছেন।
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি সেখানে সিইও হিসেবে যোগদান করেন নাজিম উদ্দিন। যোগদানকালে বিরাজকে নাজিমের ব্যক্তিগত এবং প্রশাসনিক কাজ করতে আদেশ করা হয়।
অভিযোগ উঠেছে, এই অফিস সহকারীর দিকেই মিথ্যা সহানুভূতির হাত বাড়িয়েছিলেন নাজিম। বিরাজের চাকরি স্থায়ী করে দেওয়ার মিথ্যা প্রলোভন দেখানো শুরু করেন তিনি। এক পর্যায়ে বিরাজও প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে।
চাকরি স্থায়ী করে দেওয়ার কথা বলে বিরাজের কাছ থেকে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ৫০ হাজার টাকা, ২২ ফেব্রুয়ারি ৯৫ হাজার টাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ৩০ হাজার টাকা নেন নাজিম। ২৩ ফেব্রুয়ারি আরও ৫ হাজার টাকা মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে দেন বিরাজ।
২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা ২২ মিনিটে মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা, পরে ২৫ হাজার টাকা ও পুনরায় ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয় নাজিমকে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যাবতীয় লেনদেন সবই নাজিম তার ব্যক্তিগত বিকাশ নম্বর (০১৭৫১৪১****) থেকে করেছেন।
এছাড়া, নাজিম উদ্দিনের কথা মতো ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ইসলামি ব্যাংকের কলারোয়া শাখার শাহিদা নামের একজনের হিসাবে (নং ২০৫০১৬৯০২০৩৬০****) ৫০ হাজার টাকা জমা দেন বিরাজ।
গত ১০ মার্চও একই অনুরোধে এবি ব্যাংকের সাতক্ষীরা শাখায় মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান নামের একজনের একাউন্টে (হিসাব নং- ৪২১৪৫৭৮৪৭****) ৯ হাজার টাকা জমা দেন।
অন্যদিকে চাকরি স্থায়ী করার কথা বলে বিরাজের মাধ্যমেই অফিস সহায়ক রুবেল ও রেজার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে মোট ১ লাখ টাকা নেন নাজিম। ভয়-ভীতি দেখানোর কারণে বিষয়টি ওই দুজন তারা গোপন রেখেছেন বলে জানান বিরাজ।
অবাধ্য হলেই হুমকি
গত ৬ এপ্রিল আনুমানিক দুপুর ২টা থেকে ৩টার মধ্যে কাজী বিরাজকে ২১২ নং কক্ষে ডেকে রুমের দরজা বন্ধ করে দেন নাজিম। এরপর বিরাজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেন।
সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন পৌরসভার বড়বাবু প্রশান্ত প্রসাদ ব্যানার্জী, তহমিনা খাতুন এবং অফিস সহায়ক কামাল উদ্দিন।
নাজিম তার অসৎ কার্যকলাপের প্রমাণ লুকাতেই মূলত বিরাজের ফোন কেড়ে নেন। এরপর বিরাজকে মাদক ব্যবসায়ী আখ্যায়িত করে চাকরি থেকে বহিষ্কার করেন। এমনকি বিরাজকে হত্যার হুমকি দেন বলেও অভিযোগ আছে।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কাজী বিরাজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চাকরি স্থায়ী করার কথা বলে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন নাজিম উদ্দিন। যখন তার প্রতারণা বুঝতে পারি, তখন বলি, স্যার আমার সর্বনাশ করবেন না। আমি গরিব, টাকাটা ফেরত দিন। তখন তিনি আমাকে অফিসের সবার সামনে মাদক মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আমাকে চাকরিচ্যুতও করেন।’
কথায় বনিবনা না হলে কর্মচারীদের গালিগালাজ ও ‘ক্রসফায়ারে’র হুমকি দেন বলে নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় পৌরসভার পানি সরবরাহ শাখার কয়েকজন মাস্টাররোলের কর্মচারীর সঙ্গে।
নাজিম উদ্দিনের আচরণে ভীত হয়েই এ শাখার কর্মচারীরা পৌর মেয়রের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এতেও ক্ষুব্ধ হন নাজিম।
পানি সরবরাহ শাখার কয়েকজন কর্মচারী জানান, সিইও তার খেয়াল-খুশি মতো পানি সরবরাহ শাখার যে কাউকে তার অফিস রুমে ডেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ ক্রসফায়ার ও জীবন নাশের হুমকি দেন।
এছাড়া চাকরিচ্যুত, জেল জরিমানা করার হুমকিও দেন। প্রায়ই বলেন, যে কাউকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তিনি।
নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ— পানি সরবরাহ শাখার মো. আনারুল ইসলামকে তিনি তার রুমে ডেকে অসদাচরণ করেন। ১৭ এপ্রিল আরেক কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমানকে ডেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও ক্রসফায়ারের হুমকি দেন।
১৯ এপ্রিল একই শাখার মো. আরিফুর রহমান, শেখ মোস্তাফিজুর রহমান ও আরিফ আহম্মেদ খানকেও রুমে ডেকে শাসিয়ে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মেয়রের কাছে কী অভিযোগ দিয়েছো?’।
এমনটা বলেই তিনি ওই তিন জনের ওপর চড়াও হন। এরপর হাজিরা খাতা এনে তাদের নাম কেটে বাতিল ঘোষণা করেন এবং মৌখিকভাবে বলেন ‘তোরা কাল থেকে পৌরসভা গেটের ভেতরে ঢুকবি না।’
মাস্টাররোলের কর্মচারীদের অভিযোগ
এরপর থেকেই ওই কর্মকর্তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানান বাংলা ট্রিবিউনকে।
সাতক্ষীরার পৌর মেয়র মো. তাজকিন আহমেদ বলেন ‘আমি অবাক হয়েছি যে, আমার সঙ্গে সিইও নাজিম উদ্দিনের কোনও ব্যক্তিগত রেষারেষি ছিল না। তারপরও তিনি আমার সম্পর্কে ১০ জন কাউন্সিলকে দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে দিয়েছেন। যদিও সেটা তদন্তাধীন। তবে দৃঢ়ভাবে বলছি, আরও ১০ বারও যদি আমার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়, তারপরও কোনও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নাজিম উদ্দিনের কারণে বর্তমানে পৌর এলাকায় নাগরিক সেবা শতভাগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। কর্মকর্তাদের হুমকি, জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে রাখতে চাইছেন তিনি। বিধি অনুসারে, সব কাজের আগে সিইওকে মেয়রের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু তিনি আইনের তোয়াক্কা করেন না। চারপাশে ভীতিকর পরিস্থিত তৈরি করে রেখেছেন। তার খুব দম্ভ। সবার সামনে বলেন, তার নাকি কিছুই হবে না।’
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে নাজিম উদ্দিনের মন্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল কেটে দেন। পরে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১৫ মার্চ -এর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে নির্যাতনের ঘটনায় তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিনকে এক ধাপ পদাবনতি দেওয়া হয়। নাজিম উদ্দিন তার ‘গুরুদণ্ড’ মওকুফ করতে ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে পুনর্বিবেচনার আবেদন জানালে রাষ্ট্রপতি ওই শাস্তি বাতিল করেন। সুত্র- বাংলা ট্রিবিউন/banglatribune.com