নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হতে বঞ্চিত এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু, যুবক ও বয়স্কদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে তালা উপজেলা সহ সাতক্ষীরা জেলার ৬টি উপজেলায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্য্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অধিন, ৪ বছর মেয়াদী আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রোগ্রাম (পিইডিপি-৪) বাস্তবায়নের জন্য যেসকল নীতিমালা বা নির্দেশনা রয়েছে।
তার কোনও কিছু না মেনে বরাদ্দের টাকা হরিলুট করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাতক্ষীরা জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা সাস পরস্পর যোগসাজসে লুুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। সাতক্ষীরা জেলায় অল্প সংখ্যক ঝরে পড়া শিশু শিক্ষার্থী থাকলেও কাগজে কলমে এই সংখ্যা সাড়ে ১২ হাজার দেখিয়ে প্রকাশ্যে লুটপাট চালানো হচ্ছে। বর্তমান বৈশ্বিক মন্দারসময়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনায় জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানাগেছে, সাতক্ষীরা জেলায় ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর
সংখ্যা মাত্র ১৩শ। অথচ, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্পে জেলার ৬টি উপজেলায় ৪২০ স্কুলে পড়ানো হচ্ছে সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষার্থীকে। এই বিপুল সংখ্যক ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ে বিপাকে রয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। এছাড়া, শিক্ষার্থী ঝরেপড়া রোধে প্রশাসনের তৎপরতা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্যাচমেন্ট ভিত্তিক জরিপ, সরকারের উপবৃত্তি ও শিশু খাদ্য প্রদান সহ প্রাথমিক শিক্ষা অফিস প্রদত্ত ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যান রিপোর্টকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। জানাগেছে, তালা, সাতক্ষীরা সদর, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলাতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সাস এবং কলারোয়া উপজেলায় উন্নয়ন পরিষদ (উপ) এবং কালিগঞ্জ উপজেলায় ইডা নামের অপর দুটি এনজিও সাস’র সহযোগী হিসেবে আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রোগ্রামটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নামে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগন এবং এনজিও ৩টি পরস্পর যোগসাজসে সরকারের কোটি কোটি টাকা
লুটপাট করছে। একইসাথে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নামে সরকারের শিক্ষা বিভাগের ভাবমূর্তী ক্ষুন্ন করছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। সরজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, সাতক্ষীরা জেলার ৪২০টি তথাকথিত উপানুষ্ঠানিক স্কুলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, খুপড়ি ঘর, বাঁশ বাগান অথবা মাঠের মধ্যে ডোবার ধারে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। বিভিন্নভাবে ঝরে পড়া ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী ঝরে পড়া শিশুদের এসব স্কুলে পড়ানোর কথা থাকলেও এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শিক্ষার্থীর নাম ওইসব স্কুলের রেজিষ্টার খাতায় লেখা রয়েছে। স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও ড্রেসসহ ৩২ প্রকার উপকরণ দেয়ার কথা থাকলেও শুধুমাত্র বই, খাতা ও পেনসিলেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া ২৪০ বর্গফুটের ঘরে পড়ালেখার নির্দেশনা থাকলেও তা একেবারেই উপেক্ষিত রয়েছে। সাতক্ষীরার ৬টি উপজেলার মধ্যে সদর, তালা, কলারোয়া, আশাশুনি, দেবহাটা ও কালিগঞ্জ উপজেলায় ঝরেপড়া শিশুদের ৪২০টি স্কুল প্রতি ৩০ জন করে মোট ১২হাজার ৬০০ জন শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম চলমান। অথচ এই ৬টি উপজেলায় ১৯ থেকে ২১ সাল পর্যন্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের প্রতিবেদনে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ২৮৮ জন। এই প্রকল্পে ৪২০ জন শিক্ষক, ৩০জন সুপারভাইজার ও ৬জন প্রোগ্রাম অফিসার নিয়োগের সময় ঘুষ হিসেবে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন’র টাকা থেকে মোটা অংকের টাকা কমিশন হিসেবে কেটে নেয়া হয় জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে একাধিক শিক্ষক। এছাড়া স্কুল ঘর বাবদ ঘর মালিককে ১৫শ টাকা প্রতিমাসে ভাড়া দেবার কথা থাকলেও ঘরগুলো ছোট ও অনুপযোগী হওয়ার সুযোগে দেয়া হচ্ছে ৭শ থেকে ৮শ টাকা করে। এসাথে শিক্ষা উপকরন ক্রয়ে দূর্ণীতি, উপকরন ঠিকমতো না দেয়া সহ নানান অভিযোগ রয়েছে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে। তালা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তালা উপজেলার নিয়মিত শিক্ষার্থী নিয়েই কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা করলে ইউএনও’র কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়। এ উপজেলাতে সাস এনজিও ৭০টি স্কুলের দাবী করলেও তা ২০/২২টির বেশি নয়। তিনি জানান, এই উপজেলায় ১২৮জন ঝরে পড়া শিশু রয়েছে। যারা সকলে শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং তাদের পক্ষে বিদ্যালয়ে যাতায়াত সম্ভব নয়। কিন্তু সাস ২১০০ ঝরে পড়া শিক্ষার্থী কোথায় পেয়েছে তা আমার জানা নেই। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রাথমিক ও গনশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের এই প্রকল্পটি অত্র দপ্তরের তত্বাবধানে পরিচালিত থাকার কথা। কিন্তু আমাকে কিছু না জানিয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের তত্বাবধানে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি সাতক্ষীরার সদরের বালিয়াডাঙ্গা উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে বেলা ১১টায় দেখা যায় স্কুলটি বন্ধ, স্কুলের সামনে বাথরুম ও গরুর গোবরগাদা। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ন পুশকুনি ও বাঁশবাগানের মধ্যে টিনের খুপড়িঘরেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলে। শিক্ষার্থীরা অনেকেই পাশের বাবুলিয়া স্কুলে পড়ে। এরপর খানপুর হাটখোলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ৬জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি ঘরের অর্ধেক মুরগির খামার আর অর্ধেক স্কুল হিসেবে ক্লাস করছেন শিক্ষক মৌসুমী ইসলাম। তালার চরগ্রাম, খাজরা, আটারই, দেওয়ানীপাড়া, ফতেপুর, দোহার, আটুলিয়া, শিবপুর ও মাগুরা সহ একাধিক উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে দেখা যায়, নিয়ম বহির্ভূতভাবে পাশ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডার গার্টেন ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলগুলো চালানো হচ্ছে। প্রতিটি স্কুলে ৩০জন শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও ক্লাসে হাজিরা দিচ্ছে ৮/১০জন শিক্ষার্থী। যারা সকলেই অন্য বিদ্যালয়ের নিয়োমিত শিক্ষার্থী এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে সরকারি উপবৃত্তি সহ
অন্যান্য সুবিধাভোগী। এই সকল বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলাকালে দেখা যায়, শিশু শিক্ষার্থীদের কৌশলে মিথ্যা বলা শেখানো হচ্ছে। বিদ্যালয় পরিদর্শনে আগতদের প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সংক্রান্ত শিক্ষা সংক্রান্ত কিছু বলতে না পারলেও এনজিও এবং প্রকল্পের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কথা তাদের একদম মুখস্ত। যার অধিকাংশ কথা মিথ্যা এবং বানোয়াট। শিক্ষার্থীদের মিথ্যা বলা শেখানোর ঘটনায় অভিভাবকদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এবিষয়ে সাসের সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কর্মকর্তা মো. শাহ আলম বলেন, স্কুলগুলোতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সেগুলো দেখা হচ্ছে। এব্যপারে সাতক্ষীরা জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র উপ-পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস জানান, এক জনের পক্ষে সকল জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া যারা ঝরে পড়েছে কিংবা কোনদিন স্কুলে যায়নি তাদের শিক্ষাদান করা খুবই কঠিন। আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও একটা ভাল কিছু উপহারদেয়ার প্রত্যয় আমি রাখছি।