আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে সাতক্ষীরার বোরো ক্ষেত। মাঠের পর মাঠ বোরো ধানের ক্ষেত সাদা হয়ে গেছে। ধানের পরিবর্তে বাতাশে দোল খাচ্ছে চিটা ধান। মাঠের দিকে দূর থেকে তাকালে মনে হয় ধানগুলো পেকে আছে। কিন্তু ধান ক্ষেতের পাশে গেলে দেখা মিলছে ধানের ভেতর কোন চাল নেই। ধান চিটায় রূপ নিয়েছে। এতে সর্বশান্ত হতে চলেছে হাজারো বোরো চাষী। ক্ষতবিক্ষত কৃষকের স্বপ্নের ফসলন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে । ফসল ঘরে তোলার পূর্ব মুহূর্তে ধানের ব্লাষ্ট রোগ দেখা দেয়ায় কৃষকেরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের মুখে হাসির পরিবর্তে ঝড়ছে চোখের জল। কৃষক ফসলি জমিতে গিয়ে হতাশা আর কান্নায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ফসলের রোগ সমাধানের জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন কৃষি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ওষুধের দোকান গুলেতে। এরপরও হচ্ছে না প্রতিকার। আশা করেছিলেন বাম্পার ফলনের কিন্তু শীষ গজানোর পর ধীরে ধীরে পাল্টে যায় চিত্র ।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ধানের পাতা ও শীষ পুড়ে যাওয়া এ রোগটির নাম ব্লাস্ট রোগ। এ রোগে প্রথমে পাতা পুড়ে যেতে শুরু করে। পরে ওই পাতাটি শীষের সংস্পর্শে এলে শীষও পুড়ে যায়। গত বছর এ রোগটি জেলার বিভিন্ন এলাকাতে ব্যাপকহারে ছিল। এ বছর আকাশ বৃষ্টি পাত না হওয়ার কারণে ধানের ব্লাষ্ট রোগটি ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। তবে কৃষকদের অসচেতনতা ও সময়মতো বালাইনাশক ব্যবহার না করাকে দায়ী করছে কৃষি বিভাগ।
ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকেরা জানান, ইরি-বোরো মৌসুমের আবাদ বছরের সবচেয়ে বড় আবাদ। এই সময়ে চাষ করা ধানের উপরই তাদের পুরো বছর চলে যায়। প্রতি বিঘা ধান চাষে তাদের ১০/১২ হাজার টাকা খরচ হয়। সুদে টাকা ধার নিয়েও কেউ কেউ ধান চাষ করেন। কিন্তু ভয়াবহ এই ব্লাস্ট রোগের কারণে পুরো ধান পুড়ে গিয়ে খড় টিকে রয়েছে জমিতে। ফলে অনেক কৃষকই এবার সর্বশান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন।কৃষকেরা আরও বলেন, গত বছরও এই রোগেই তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এ বছরও একই অবস্থা। কৃষি অফিসারদের পরামর্শে ওষুধ প্রয়োগ করেও ধান পুড়ে যাওয়া ব্লাস্ট রোগ থেকে রক্ষা হয়নি।
তালার মুড়াগাছা গ্রামের কৃষক আজিজ মোড়ল বলেন, 'তিন বিঘা জমিতে ব্রি২৮ জাতের ধান চাষ করেছেন তিনি। অধিকাংশ ধানের শীষ বের হয়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাতা ব্লাস্ট রোগে গাছ সাদা হয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যা করেও কোনো লাভ হয়নি।'
এর পরও এবার দেশজুড়ে বোরো আবাদ রেকর্ড সৃষ্টি করবে বলে দাবী করেছে সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, বাজারে ধানের চড়া দামই বোরো আবাদে কৃষকদের উৎসাহ জুগিয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে সরকারের নানা প্রণোদনাও। ফলে সব মিলিয়ে এ বছর বোরো আবাদ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। আর আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এ বছর বোরো চাল উৎপাদনেও নতুন রেকর্ড সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। কোন প্রাকৃৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে এ বছর বোরো চাল উৎপাদন ২ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি ২০২১-২২ মৌসুমে দেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৮ লাখ ৭৩ হাজার হেক্টর।
সাতক্ষীরা খামার বাড়ি সূত্রে জানা গেছে, এবার ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে জেলায় বোরো ধানের চাষ হচ্ছে। এরমধ্যে জেলার সদর উপজেলার ধুলিহর ও ঝাউডাঙা, কলারোয়া পৌর ব্লক ও কেরালকাতা ব্লক, দেবহাটা উপজেলার সদর ব্লক ও তালা উপজেলা সদর ব্লকে ৩০০ একর জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে ট্রেতে বীজ বপন ও মেশিনে পাতা রোপনের মাধ্যমে হাইব্রীড তেঁজগোল্ড জাতের বোরো ধানের চাষ হয়েছে। ফলনও বেশ ভাল।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, মৌসুমী প্রণোদনার রাইস ট্রান্সপান্টের আওতায় ১৫০ বিঘা জমিতে সমালয় পদ্ধতিতে হাইব্রীড বোরো ধানের চাষ হয়েছে। খরচ কম হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হবে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপপরিচালক নুরুল ইসলাম জানান বলেন, ধানের এই রোগটির নাম ব্লস্ট রোগ। আক্রান্ত বীজ থেকেই এ রোগটি ছড়িয়ে যায়। এছাড়াও বেশি ইউরিয়া প্রয়োগের কারণেও এ রোগ হতে পারে। ব্লাস্ট রোগ প্রথম পাতায় ধরে, তখন সেটাকে লিফ ব্লাস্ট বলা হয়। ধীরে ধীরে এটা শীষে যায়। তবে একটি গাছে এ রোগ ধরলে একটি পাতা থেকে অপর পাতায় যায়। নির্দিষ্ট সময়ে বালাইনাশক দেয়া হলে এ রোগটা ছড়ায় না। তিনি আরো বলেন, এ বছর আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছি আক্রান্ত বীজ ব্যবহার না করা এবং শীষ গজানোর আগেই ওষুধ প্রয়োগের জন্য। এ কারণে এবার রোগটা অতিমাত্রায় বিস্তার লাভ করেনি।